আতাউর রহমান ও আব্দুল আজিজ দুজন সর্ম্পকে মামা-ভাগ্নে। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার অজপাড়া গাঁয়ের গোদারচালা গ্রামে তাদের বাড়ি। বয়সের ব্যবধান খুব বেশি না হওয়ায় সম্পর্ক বন্ধুত্বকে ছাড়িয়ে গেছে। স্নাতক পর্যন্ত পড়ালেখা শেষ করে দুহন মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন দেশে বিদেশি ফল চাষ করে কিছু একটা করা চেষ্টা করবেন। এই ভাবনা থেকে তারা কাজ শুরু করলেন।
২০১৩ সালের প্রথম দিকে ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে নিজেদের পতিত জমিতে স্ট্রবেরির চাষ করেন। তাদের হাত দিয়ে গাজীপুরে প্রথম স্ট্রবেরি চাষ শুরু হয়। সবাইকে তাক লাগিয়ে প্রথম বছর আয় হয় ১১ লাখ টাকা। এভাবে দ্বিতীয় বছর ১৬ লাখ ও তৃতীয় বছর ১৮ লাখ টাকা লাভ করেন। এতে দু’জনের কর্মস্পৃহা ও উদ্দীপনা আরও বেড়ে যায়। এরপর আস্তে আস্তে ড্রাগন ফল, থাই পেয়ারা ও বারি-২ জাতীয় মাল্টা চাষ শুরু করেন। নিজেদের শ্রম ও মেধায় প্রতিনিয়ত সফলতা পাওয়ায় কয়েক বছরেই ১০ একর জুড়ে জমিতে গড়ে তুলেন বিদেশি নানা ধরনের ফলের চাষ।
কৃষি কর্মকর্তাদের তথ্য মতে, ব্যক্তি উদ্যোগে এটিই জেলার সবচেয়ে বড় বিদেশি ফলের বাগান। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে তাদের লক্ষ্যমাত্রা চলতি বছরেই কোটি টাকার ওপরে ফল বিক্রি হবে। এখন এই বিদেশি ফল চাষ পুরো জেলায় ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কাজ শুরু করেছেন তারা।
গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের গোদারচালা গ্রামে তারা এই কৃষি খামার গড়ে তুলেন। সড়ক পাশে বাড়ির চারপাশ জুড়ে যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু দেখা যায় মাল্টার বাগান। দু’বছর বয়সী বাগানের ভেতর ঢুকেই দেখা গেল গাছের সবুজ পাতার ভেতর থেকে থোকা থোকা মাল্টা উঁকি দিচ্ছে। গাছে এখন পরিপক্কতায় রূপান্তরিত হচ্ছে মাল্টাগুলো। কয়েকমাসের মধ্যেই পরিপক্কতার সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় হলুদে রঙে ধারণ করবে। তাদের বাগানে বর্তমানে ১০ হাজারের ওপর উৎপাদনশীল বারি-২ জাতীয় মাল্টা গাছ, কয়েকশ ড্রাগন ফলের গাছ রয়েছে। দুবছর বিরতির পর কিছুদিন আগে আবারও শুরু করেছেন স্ট্রবেরি চাষ। তবে লাভজনক থাইপাতা চাষ করে সফলতা পেয়েছেন। এসব ফলের ভেতর আবার স্বল্প মেয়াদী সঙ্গী ফসল হিসেবে বেগুন চাষ করেছেন। যা অনেকটা একের ভিতর দুইয়ের মত। নিজেরা স্বল্প সময়ে বিদেশি ফল চাষে সফলতা অর্জন করায় এখন এসব চাষ সাধারণ লোকজনের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন।
ইতোমধ্যেই তাদের বাগান থেকে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে প্রায় ২০ হাজার কলম তৈরি করছেন। যা আগামী মাস থেকেই শুভেচ্ছা মূল্যে বিক্রি হবে। তাদের লক্ষ্য বিদেশি ফল চাষে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের বিনামূল্যে পরামর্শ দিয়ে এই চাষটাকে ছড়িয়ে দেয়া। এতে বিদেশ থেকে আমদানি করা ফলের নির্ভরশীলতা অনেকটা কমবে।
উদ্যোক্তা আতাউর রহমান জানান, তার বাবা সিরাজউদ্দিন ছিল একজন কৃষক। ছোটবেলায় বাবাকে মাঠে কাজের সহযোগিতার সময় তার কৃষি কাজের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। তাই লেখাপড়া শেষে তিনি নিজেই কৃষি কাজে আত্মনিয়োগ করেন এসময় তার সঙ্গে ভাগ্নে আব্দুল আজিজকে রাখেন। প্রথমেই তারা ব্যতিক্রমী ধারণা নিয়ে বিদেশি ফলের চাষ শুরু করেন। কৃষি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মতে তিনি গাছগুলোর পরিচর্যা করে সফলতা পান। তবে তার স্বপ্ন ছিল আরও বড় পরিসরে এ চাষ করার। তবে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে জমির স্বল্পতা। শ্রীপুরের বিভিন্ন এলাকায় শিল্পায়ন হওয়ায় একসঙ্গে অধিক পরিমাণে কৃষি জমি পাওয়া যায় না। আবার পেলেও কেউ দীর্ঘদিনের জন্য ইজারা দিতে চান না। দেশের মাটিতে বিদেশি এসব উৎপাদিত ফল সুস্বাদু হওয়ায় সাধারণ বাজারদরের চেয়ে দামও বেশি পাওয়া যায়। আর বিষমুক্ত হওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে এর চাহিদা রয়েছে।
অপর উদ্যোক্তা আবদুল আজিজ বলেন, আমরা যখন এসব ফল চাষের সিদ্ধান্ত নিলাম তখন আর পেছনে ফিরে তাকাইনি। পরিবার, বন্ধু ও স্বজনদের কাছ হতে বাধা এসেছে। তবু থামিনি। আমাদের লক্ষ্য ছিল যেভাবে হোক সামনে এগুতে হবে। কয়েক বছরেই আমরা সফল হয়েছি। আমাদের দেখাদেখি অন্যরা এগিয়ে আসে তাহলেই বিদেশ থেকে ফলের আমদানী নির্ভরতা কমবে।
এ বিষয়ে শ্রীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুয়ীদ উল হাসান জানান, বারি-২ জাতীয় মাল্টা আমাদের দেশীয় আবহাওয়ার জন্য অত্যন্ত উপযোগী এটি আমাদের বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত। দেশের মাটিতে উৎপাদিত মাল্টা খুবই সুস্বাদু হওয়ায় এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এছাড়াও ড্রাগন ও স্ট্রবেরির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ দুজন সফল উদ্যোক্তা ফল চাষ করে খুব স্বল্প সময়ে সফল হয়েছে। তাদের কৃষি খামারটি এখন গাজীপুরের সবচেয়ে বড় বিদেশি ফলের খামার।